।। আকবর হােসেন।।
আজ বড়দিন। খৃষ্টান সম্প্রদায়ের জন্য সবচে’ বড় ধর্মীয় দিবস। কিন্তু করােনা ভাইরাসের কারণে ইউরােপ- আমেরিকাসহ অন্যান্য দেশে যথাযথভাবে তারা এ দিবসটি পালন করতে পারছে না । এবার সীমিত পরিসরে বলা যায় একরকম একাকীই পালিত হবে বড়দিন। মহামান্য রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ শুভেচ্ছা বক্তব্যে বলেছেন, আপনি একা নন। রাতের গভীরতম অন্ধকারের পর একটি নতুন সূর্যােদয়ের উদাহরণ দিয়ে তিনি জাতিকে আশার বাণী শুনিয়েছেন। আমরাও খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী সবাইকে জানাচ্ছি বড়দিনের শুভেচ্ছা। আমাদের লন্ডনে এখন টিয়ার ফাের। সুতরাং অনেক বাধানিষেধ আছে দিবস উদযাপনে। হরহামেশা যেভাবে ফ্যামেলি গেদারিং হয় এবার তা হচ্ছে না। এই ভাইরাসের জন্য আমরা ঈদুল ফিতর যথাযথভাবে পালন করতে পারিনি এবছর। এখন খৃষ্টান সম্প্রদায়ের জন্যও দিনটি তাদের মতাে করে পালন করা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য তাদের ব্যথার সাথে আমরাও ব্যথিত। বাইরে গাড়ি চলাচল কম হলেও মসজিদে জুমুআর নামাজগামী মুসুল্লীদের গাড়িসহ বেশ কিছু যানবাহন চােখে পড়েছে আমাদের এলাকায়। সাদা মানুষেরা রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়েছে। কী আর করা। পার্কে বন্ধু বা অন্যান্য সদস্যদের সাথে মিলিত হয়ে কিছুটা হলেও আনন্দ উপভােগ করছে। কারণ নিজেদের ঘরে বাইরের কারাে জন্য কােন আয়ােজন নেই। মেলামেশা, আনাগােনা, নিমন্ত্রণ সবই বলা যায় নিষেধ। আমাদের প্রতিবেশিরা কার্ড ও চকলেট এবং অন্যান্য গিফ্ট দিয়ে আমাদের বড়দিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছে। আজ রাতে তারা অত্যন্ত ব্যতিক্রমধর্মী ক্রিসমাস ডিনারে মিলিত হবে। তবে বাইরের কারাে সাথে নয়, শুধুমাত্র নিজের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। এর পূর্বে কখনাে এরকম ঘটেছে কী না তা জানা নেই।
জুমুআর নামাজের বুকিং রাতেই দিয়েছিলাম হাউন্সলাে মসজিদে। কিন্তু মসজিদের গেইটে কিউআর কােড দেখাতে না পারলেও কর্তৃপক্ষ নামাজ আদায়ের সুযােগ দিলেন। নামাজ শেষে ওয়েষ্ট লন্ডন এলাকার পাউডারমিল লেইন কবরস্থানে চলে আসলাম। যেখানে একপাশে আছে খৃষ্টানদের কবর এবং অন্যপাশে মুসলিমদের। একটি জানাজায় অংশ নিলাম। আমাদের এলাকার একজন মুরুব্বী, বিশিষ্ট সমাজসেবী ও কমিউনিটি নেতা জয়নাল আবেদীন সাহেব গতকাল ইন্তেকাল করেন। করােনা ভাইরাসের কারনে মসজিদে জানাজা না হয়ে কবরস্থানের মাঠে জানাজা আদায় করা হলাে। তারপর তাকে সমাহিত করা হয়। আমরা তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। তিনি খুবই অমায়িক ও একজন ভালাে মনের মানুষ ছিলেন। তার মৃতু্্যতে কমিউনিটির অনেকেই ছুটে এসেছেন। এই সুযােগে সবার সাথে দেখা হয়ে গেলাে। ভাইরাসের কারণে তাদের সাথে সচরাচর দেখা হতাে না। সেইসাথে কবর জিয়ারতও হয়ে গেলাে। মরহুম জয়নাল আবেদীন সাহেবের ভাগিনা ও দামান্দ সিরাজ ভাই পরিবারের পক্ষ থেকে সবার কাছে দােআর আহবান জানান। আরেক ভাগিনা জানাজার নামাজ পড়ান এবং ইমাম আবু সাঈদ আনসারী উপস্থিত সবাইকে নিয়ে দােআ পরিচালনা করেন। ফাকে আমি আমার শ্রদ্বেয় শশুড় হাজী আব্দুল মন্নানের কবরও জিয়ারত করলাম যিনি 2014 সালে ইন্তেকাল করেন। তার কবরের পর আশেপাশে আরাে অনেকের কবর হয়েছে। কিছুদিন পূর্বে এলাকার অন্য একজন মুরুব্বীর জানাজায় গেলে আমার শশুড়ের কবর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু আজ খুঁজে পেয়ে বেশ ভালাে লাগলাে। আমার শশুড়সাহেবসহ কবরবাসী আত্মীয়স্বজন ও মুসলিম নরনারীদের জন্য দােআ করলাম। এর আগে মসজিদের ইমাম সাহেব কারােনা ভাইরাস থেকে বিশ্ববাসীর মুক্তির জন্য দােআ করেছেন। পাউডারমিল লেইন কবরস্থানে শুধু আমরাই যাইনি। আজকের বড়দিনে খৃষ্টান সম্প্রদায়ের লােকজনও এসেছেন আপনজনদের কবর ভিজিট করতে। আজ কােথায় যেনাে আমরা আদম সন্তান এক কাতারে এসে দাঁড়ালাম। খৃষ্টান লােক কবর খুঁড়ছে আর মুসলিমদের মাটি দেয়া হচ্ছে। খােলা আকাশের নীচে দুনিয়া জাহানের মালিক রাব্বুল আলামীনের দরবারে দােআ করা হচ্ছে।
বাইরে বেশ ঠান্ডা পড়েছে। তবে আকাশ পরিস্কার। কিছুটা রােদের আলাে ঝলমল খেলা আছে আকাশে। ক্রিসমাসে স্নাে হলে খৃষ্টানরা খুশি হন। তারা স্নাে পড়লে হােয়াইট ক্রিসমাস বলেন।জার্মানীতে প্রায়ই ক্রিসমাসে তুষারপাত হতাে। চারদিক সাদা হয়ে যেতাে পেজা তুলাের মতাে। কিন্তু এখানে সেই তুষারপাত হয়না। ডিসেম্বরথর দিনটি খুবই ছােট। চারটার পূর্বেই সূর্য ডুবে যায়। গাছগাছালী আর পাখির কিচিরমিচির আর সবুজ জমিনের পাউডার মিল লেইন কবরস্থান আমাদের বাগময়না গ্রামের ইকড়দাইরস্থ কদমবাড়ির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। যেখানে আমার বাবা শহীদ আকলু মিয়া সহ দাদাদাদী, চাচাচাচী সহ অনেক আত্মীয় স্বজনের কবর রয়েছে। ভাবি এটিই আমাদের শেষ ঠিকানা। একদিন মাটির নীচেই সবাইকে যেতে হবে। “মিনহা খালাক্বনাকুম ওয়া ফিহা নুইিদুকুম ওয়া মিনহা নুখরিজুকুম তারাতান উখরা”। অর্থাৎ “এই মাটি থেকেই তােমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে, এই মাটিতেই তােমাদের ফিরিয়ে নেয়া হবে এবং এই মাটি থেকেই পুনরায় আবার তােমাকে জীবিত করা হবে”। মুর্দাকে কবরে রাখার সময় আমরা বলি “বিসমিল্লাহি আলা মিল্লাতি রাসুলিল্লাহ”। আমরা এই মাটিতে আবার ফিরে যাবাে। খৃষ্টানরাও কবরে লাশ রাখার সময় এই কথা স্মরণ করেন বলে জেনেছি। অন্য ধর্মে কী আছে তা আমার জানা নেই। একদিন মাটির ভেতরে হবে ঘর রে মন আমার, কেনাে বান্ধ দালান ঘর। কথাটি ঠিক মনে হলেও আমরা দুনিয়ার বসতির জন্য সবকিছুকেই যেনাে বিসর্জন দিতে ভীষণ ব্যস্ত। আসল বসতির গড়ার কাজে পিছপা থাকি। মাঝে মধ্যে কবর জিয়ারত, জানাজা ও লাশ দাফনে গেলে আমাদেরই বেশি ফায়দা হয়। অন্ততঃ কিছু সময়ের জন্য হলেও আমরা মৃত্যুর কথা স্মরণ করি। নিজেকে পরিশুদ্ধ করার জন্য তাও কম কিসে!
আলহামদুলিল্লাহ এখন পর্যন্ত সুস্থ আছি। চারদিকে শুধু অসুস্থতার খবর। মৃত্যুর মিছিল ক্রমশ দীর্ঘায়িত হচ্ছে। ফেইসবুক, হােয়াটসআপ খুললেই পরিচিত অপরিচিত অনেকের মৃত্যুর খবর আসে। করােনা এমন এক অসুখ ইচ্ছা থাকলেও কারাে সাথে দেখা করা যায় না। এরকম মৃত্যু কারাে কাম্য না হলেও এটিই নিয়তি। কারো জন্ম হবে কিনা তা নিশ্চিত না হলেও মৃত্যু যে একদিন আসবে তা নিশ্চিত। আমার এক বন্ধু বলেন, এর কােন সিরিয়াল নেই। আসলেই তাই। দােআ করি সবার সুস্থ ও সুন্দর জীবনের জন্য। আমার একটি প্রিয় গান দিয়ে আজকের মতাে এখানেই শেষ করছি।
মরিলে কান্দিস না আমার দায় রে যাদু ধন, মরিলে কান্দিস না আমার দায়।
সুরা ইয়াসীন পাঠ করিবা বসিয়া কাছায়
আমার প্রাণ যাওয়ার বেলায়
বিদায় কালে পড়ি না যেন শয়তানের ধোঁকায়
বিদায় কালে পড়ি না যেন শয়তানের ধোঁকায়।
বুক বান্দিয়া কাছে বইসা গোছল দেওয়াইবায়
আমার কথা রাখিবায়
কান্দনের বদলে মুখে কলমা পড়িবায়।
কাফন পিন্দাইয়া আতর গোলাপ দিয়া গায়
যখন বিদায় করিবায়
তেলাওয়াতের ধ্বনি যেন ঘরে শোনা যায়….
************************************
আকবর হােসেন,লন্ডন
akbargermany92@gmail.com