সুলায়মান আল মাহমুদ
দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনায় সিলেটের সিটি নির্বাচন আর এ নির্বাচনের ফলাফল। প্রথমেই জিঞ্জেস করে নিই- আপনার কি বিশ্বাস হয় যে, বরিশালের সাবেক মেয়র, সাবেক এমপি ও কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মুজিবুর রহমান সারোয়ার বরিশাল সিটির নির্বাচনে কি মাত্র ১৩ হাজার ভোট পেয়েছেন? মুজিবুর রহমান সারোয়ারের মতো একজন জাতীয় নেতা এবং বার বার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির প্রাপ্ত এই ভোট যদি হাস্যকার আর অবিশ্বাস্য মনে হয়; তাহলে সিলেটের ক্লিন ইমেজধারি নেতা এহসানুল মাহবুব জুবায়ের ভাইয়ের ক্ষেত্রে কিংবা জামায়াতের ক্ষেত্রে কেমনে আপনার বিশ্বাস হয় যে- এই নগরীতে জামায়াতের মাত্র ১১ হাজার ভোট?
এই তো গেল ৩০ জুলাই অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো সিলেট সিটি নির্বাচন। নির্বাচন কমিশনের একজন কার্ডধারি পর্যবেক্ষক হিসেবে দিনভর বেশ ক’টি কেন্দ্র পরিদর্শনের সুযোগ হয়েছিল। যা দেখেছি, যা প্রত্যক্ষ করেছি নিজ চক্ষে- দুর থেকে অনেকে অনেক মন্তব্য করতে পারেন এই নির্বাচন নিয়ে। কিন্তু আমরা যা দেখেছি- তা বলেও শেষ করতে পারবো না যে, কতটা কারচুপি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, কেন্দ্র দখল সহ নানান বিতর্কিত অঘটনের মধ্য দিয়ে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একটু দেরী হয়ে গেলো বিবরণ নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হতে। বিবেকের তাড়না কিছু বাস্তব চিত্র তুলে ধরি।
যদিও আরিফুল হক চৌধুরী এগিয়ে এবং তিনিই পাশ করবেন- এটা প্রায় নিশ্চিত। নির্বাচনের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে প্রায় বিজয়ী এই মেয়রকে অভিনন্দন জানাতে পারছিনা। দু:খিত। এমন নির্লজ্জ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া একজন প্রার্থীকে অভিনন্দন জানানো যায়না। সিলেট সিটি নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেয়া আর ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনে শেখ হাসিনা সরকারের বিজয়ী হওয়াকে মেনে নেয়া- একই কথা। কারণ, সিলেটের নির্বাচনে জিতেছে ষড়যন্ত্র আর হেরেছে গণতন্ত্র। তাই ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনের ফলাফল যেমন মেনে নিতে পারিনি, তেমনি ৩০ জুলাইয়ের নির্বাচনের ফলাফলও মেনে নিতে পারছিনা। পারবো না। যদিও এই নির্বাচনে আমার খুব প্রিয় কিছু মানুষ কাউন্সিলর পদে বিজয়ীদের তালিকায় রয়েছেন। তাদেরকেও অভিনন্দনজানানো থেকে বিরত থেকেছি। কেবলই বিবেকের তাগিদেই।
২৭ টি কেন্দ্রে যাবার সুযোগ হয়েছিল। এর মধ্যে মাত্র ৬টি কেন্দ্র ছাড়া কোন কেন্দ্রে ধানের শীষের কোন এজেন্ট কিংবা সমর্থকের দেখা মেলেনি। ২৭টির মধ্যে যদি মাত্র ৬টি হয়, তাহলে ধরে নেন- শতাধিক কেন্দ্রে ধানের শীষের এজেন্ট কিংবা কোন কর্মী ছিলনা। অথচ আরিফই পাশ করলেন! দু:খ আর কাকে বলি?
সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে আমরা ক’জন ঢুকলাম নগরীর ৯নং ওয়ার্ডের বাগবাড়ি বর্ণমালা কেন্দ্রে। এটা ছিল মহিলা কেন্দ্র। দেখলাম আওয়ামী লীগ নেতা বিধান কুমার সাহা পুলিশের সাথে ভেতরে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রিসাইডিং অফিসার তাহের আলি পীর আমাদের দেখে যেন সংকোট বোধ করছিলেন! বিধান সাহার বিষয়ে জিজ্ঞাস করতেই প্রিসাইডিং অফিসার বললেন, “উনি এখনো আছেন নাকি?” অথচ তখন উনার রুম থেকে বিধান সাহাকে দেখা যাচ্ছে। ঠিক এই সময় এই মহিলা কেন্দ্র থেকে ১৫/২০ জন ছেলেকে দ্রুত বের করে দেয়া হলো। ছেলেরা মহিলাদের এখানে কি করছে জানতে চাইলে, কেন্দ্রে দায়িত্বে থাকা যাত্রাবাড়ী থানার এসআই সুশান্ত বলেন, ‘আপনারা দেখছেন তো?’ হ্যা! তিনি হাসিমাখা কন্ঠে জবাব দিলেন, ‘আমরা দ্রুত বের করে দিয়েছি’।
এখান থেকে গেলাম পাঠানটুলা, তারপর মদন মোহন কলেজ কেন্দ্রে। দেখলাম ধানের শীষের এজেন্টরা স্বেচ্ছায় বেরিয়ে গেছেন। হয়তো ভয়ে চলে গেছেন কিংবা আরিফের প্রতি তাদের মন ভার- এজন্য চলে গেছেন। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন যে, সিলেটের বিএনপির বেশির ভাগ নেতা-কর্মী আরিফ বিরোধি ছিল এবং নির্বাচনের দিনও তারা ভেতরে ভেতরে আরিফের বিরোধিতা করে। তারপরও বিশ্বাস করতে হচ্ছে, আরিফই আবার মেয়র হচ্ছেন! ষড়যন্ত্র কাহাকে বলে- কত প্রকার ও কি কি? তাহা দেখিয়ে দিল আওয়ামী লীগ।
খবর পেয়ে দ্রুত গেলাম পাঠানটুলা জামেয়া কেন্দ্রে। সেখানে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সাথে শিবিরের ধাওয়া-পাল্টা-ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। টেবিল ঘড়ির এজেন্ট ও ভোটারদের বের করে দেয়া হয়। এরকম নগরীর আরো বিভিন্ন কেন্দ্রে ঘুরে দেখলাম অনেক সেন্টারে টেবিল ঘড়ি ও ধানের শীষের এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে। পীর মহল্লায় চোখে পড়েছে আন্ডার এইজের তথা কমবয়সী কিছু ছেলে লাইন বেঁধে শৃঙ্খলার সহিত অন্যের ভোট দেয়ার দৃশ্য। এ যেন ভোট নয়, হরিলুট চলছিল। চলছিল সার্কাস। চলছিল নির্বাচনী নাটক।
দরগাহ গেইট সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট জালিয়াতির ছবি তোলার সময় প্রথম আলোর শাবি প্রতিনিধি মিছবাহ উদ্দিন এর উপর হামলা হলে তাকে রক্ষা করতে দৈনিক জালালাবাদ এর স্টাফ রিপোর্টার সাংবাদিক কামরুল ইসলাম এগিয়ে এলে তার উপরও ছাত্রলীগ আর পুলিশ হামলা করে। আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় নেতা এডভোকেট মিছবাহ উদ্দিন সিরাজ ও শফিক চৌধুরীর কাছে সাংবাদিকরা ছুটে গেলেও তারা কোন সহযোগিতা করেননি। একটি কেন্দ্রে ছাত্রলীগের হাতে সিনিয়র সাংবাদিক আল-আজাদ ভাইও লাঞ্চিত হয়েছেন। হযরত শাহজালাল ও শাহপরান (র.) সহ ৩৬০ আউলিয়ার স্মৃতি বিজড়িত পূণভুমি সিলেটে নির্বাচনের নামে এমন নির্লজ্জ ইতিহাসের স্বাক্ষী হবো তা কোনদিন কল্পনাও করিনি। কিন্তু সে স্বাক্ষী হয়েই রইলাম।
অবাক ব্যাপার, দিনের বেলায় যেখানে আমার দেখা অধিকাংশ কেন্দ্রে ধানের শীষের এজেন্টই পাইনি; সেখানে ধানের শীষের এতো ভোটার আসবে কোন স্বর্গ হতে? এসব বহু এজেন্টবিহীন কেন্দ্রে ধানের শীষই বিজয়ী হয়েছে। অনিয়ম ও কেন্দ্র দখলের ঘটনায় আরিফ ভাইকে ক্ষুব্ধও হতে দেখেছি। তিনিও ভেবেই নিয়েছিলেন- তিনি ফেল। উনার শোচনীয় অবস্থা আঁচ করতে পারে আরিফ ভাইয়ের কাছে গুটি কয়েক ছাত্রদল নেতাকর্মী ছাড়া তেমন কাউকেই কাছে দেখতে পাইনি। তিনি তো দিনের বেলা চিৎকার করে বলছিলেন- এটা ভোট নয়, লুট। তিনি এই নির্বাচনকে মীরজাফরের নির্বাচন বলেও আখ্যা দেন। এছাড়া তিনি আরো বলেন আমি বিজয়ী হলেও এই নির্বাচন মেনে নেবো না। তাহলে আরিফের কথা অনুযায়ী তিনি কি সেই লুটের ভোটেই পাশ করেছেন? কে লুট করলো তার ভোট? তাঁর এজেন্ট আর বিএনপির নেতা-কর্মীরা যেখানে কেন্দ্রে ছিলনা সেখানে আরিফের ভোট লুটে কাজ কে করে দিয়েছে? আওয়ামী লীগ? নাকি কামরান?
বলেছিলেন, তিনি বিজয়ী হলেও নির্বাচন মেনে নেবেন না। তিনি কি তাঁর কথা রেখেছেন? সন্ধ্যার দিকেই বদলে গেল দৃশ্যপট। দেখা গেলো আরিফ ভাই আর কামরান ভাই খুব বেশী পার্থক্য নেই ভোটের হিসেবে। ধীরে ধীরে আরিফ ভাইয়ের সমর্থকরা জড়ো হতে থাকেন নির্বাচন কমিশন অফিসে। রাত বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে নেতাকর্মীদের উপস্থিতির হারও। অত:পর যা ঘটলো সিলেটবাসীই তার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী। জয়ী হতে যাচ্ছেন শুনে নেতাকর্মীরা জড়ো হলেও দিনের বেলায় আরিফ ভাইয়ের সাথে কাউকে দেখা যায়নি। অনেক সিনিয়র নেতাদের দিনের বেলায় ফেইসবুকে পোষ্ট দিতে দেখলাম নির্বাচনের নামে প্রহসন সিলেটবাসীকেও প্রত্যক্ষ করতে হলো। অথচ ফলাফল ঘোষণার পর তারাই আবার স্ট্যাটাস দিলেন অভিনন্দন জানিয়ে। তারা যুক্তি দিলেন যে, আওয়ামীলীগ কেন্দ্র দখল করেও ধানের শীষের ভোট নষ্ট করতে পারেনি। সুষ্ঠু ভোট হলে এক লাখ ভোটের ব্যবধানে আরিফ বিজয়ী হতেন।
অতপর আমরা অনেক তত্ত্ব জানতে পারলাম। নির্বাচন নাটকের স্যুটিংয়ের সাথে প্রদর্শিত ছায়াছবির কোন মিল দেখিতে পারিলাম না। বলি, ভোট উৎসবের বদলে যারা পূণ্যভুমি সিলেটে লুটোৎসব চালিয়ে রাজনৈতিক সম্প্রীতি বিনষ্ট করেছে, ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবেনা। বিজয়ী হয়েছি বলে একটি অন্যায়কে মেনে নিলে, আপনার সামনে আরো একশটি অন্যায় সংঘটিত হবে। তখন আপনাকে নিরব দর্শক হয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার থাকবেনা।



