“শুধু সেনাবাহিনী নয়, উচ্চ-আদালতও জন-রাজনীতির প্রতিবন্ধক হতে পারে। বাংলাদেশের জনগণের জীবনদান এবং দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার-ব্যবস্থাটি সংবিধানের মূল চেতনা (রাষ্ট্র নিরবিচ্ছিন্নভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা শাসিত হবে, অনির্বাচিতদের দ্বারা এক মুহূর্তও নয়)-এর পরিপন্থী দাবী করে হাইকোর্টের কতিপয় আইনজীবী একটি রীট পিটিশন দায়ের করলে প্রাথমিক শুনানী শেষে হাইকোর্ট পিটিশনটি তাৎক্ষণিকভাবে খারিজ করে দেন।
পরবর্তী সময়ে বিষয়টি আবার অন্য একটি বেঞ্চে উত্থাপন করা হলে সেই ২ জন বিচারকও তা খারিজ করেন ভিন্ন ভিন্ন কারণ দেখিয়ে। তাদের ভিন্ন ধরণের মত বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসার জন্য একটি বৃহত্তর বেঞ্চে ৩ জন বিচারক কর্তৃক একত্রে শুনানী শেষেও পিটিশনটি ৩ জনই খারিজ করে দেন। তবে উত্থাপিত প্রশ্নটির সাংবিধানিক গুরুত্ব বিবেচনা করে তা আপীলেট ডিভিশনে শুনানীর জন্য উত্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়।
এরপর বিচারপতি খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর মামলাটির শুনানী হয়। এ পর্যায়ে এসে ৪-৩ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ব্যবস্থাটিকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়।
উল্লেখ্য যে, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার পক্ষের ৪ জনের একজন ছিলেন বিচারপতি এস. কে. সিনহা, যার বিরুদ্ধে বর্তমান সরকার অনৈতিকতার অভিযোগ এনেছেন। আর মূল ‘জাজ’ খায়রুল হক ঘোষিত রায় থেকে নজীরবিহীনভাবে লিখিত রায়ে সরে গেছেন বলে রায়েই অভিযোগ করেছিলেন অপর বিচারক এম. এ. ওয়াহাব মিয়া। কিন্তু এমিকাস কিউরিদের ৮ জনের ৭ জনই ছিল ব্যবস্থাটি বাতিল না করার পক্ষে।
… এতে স্পষ্ট হয় যে, রাষ্ট্রকাঠামোর সামগ্রিক সংস্কার না করে শুধুমাত্র সংবিধানের নির্বাচন সংক্রান্ত অনুচ্ছেদটি জীবন দিয়ে সাময়িক সময়ের জন্য সংস্কার করে যে-বিজয় ছিনিয়ে আনা যায়, তা ধরে রাখা যায় না।”
“বাংলাদেশের সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্যের একটি হলো এতে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর বা সরকার বদলের পথকে রুদ্ধ করে দেওয়া আছে। এ বৈশিষ্ট্যটি এমন কার্যকরভাবে প্রণয়ন করা হয়েছিল যে, ১৯৭২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত এই সংবিধানের অধীনে নির্বাচন করে ক্ষমতাসীনরা কখনো পরাজিত বা ক্ষমতাচ্যুত হয়নি।
এই সংবিধানের অপর একটি গুরুত্বপুর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এর অধীনে যারা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পায় তারা যে-ধরণের ক্ষমতা ভোগ করে তার নজীর সভ্য দুনিয়ায় আর একটাও নাই বললেই চলে। এখানে যিনি সরকারের প্রধান নির্বাহী হিসাবে মনোনীত হন, তিনি হন রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক; রাষ্ট্র ও সংবিধান হয় তার অধীন; তিনি কারো কাছে জবাবদিহিতে বাধ্য থাকেন না, বরং রাষ্ট্রের সকলেই তার কাছে জবাবদিহিতে বাধ্য থাকে।
ফলে প্রধান নির্বাহী ছাড়াও সরকারের সাথে যারা যুক্ত থাকেন, তারাও তার অনুগ্রহে জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে বসবাস করেন। আর তাদের ধন-সম্পদের পরিমাণ এমন মাত্রায় বৃদ্ধি পায় যা অন্য কোনো বাণিজ্যিক প্রক্রিয়াতেই অর্জন করা সম্ভব হয় না।
এ দুইয়ের সম্মিলিত ফল হয়েছে ভয়াবহ। একদিকে নজীরবিহীন ক্ষমতার জোরে বিরোধী দলসহ যাকে-খুশী-তাকে দমন-পীড়ন, আর অন্যদিকে জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন ও পাচার পরিস্থিতিকে এমন মাত্রায় অস্বাভাবিক করে তোলে, যার অনিবার্য পরিণতি হিসাবে এখানে বারবারই ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে অস্বাভাবিক এবং হিংসাত্মক পথে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেনা-অভ্যুত্থান, কোনো কোনো সময় গণ-অভ্যুত্থান বা কোনো সময় দুই এর উদ্ভট মিশেলে। …”
[রাষ্ট্রচিন্তা-র পক্ষ থেকে ৭ই সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখ জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে উত্থাপিত বক্তব্যের অংশবিশেষ।]