
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে অ্যাভেনফিল্ড দুর্নীতি মামলায় জাতীয় জবাবদিহিতা আদালত ১০ বছর কারাদন্ড দেবার পর পাকিস্তানের নির্বাচনী রাজনীতিতে এর বিশেষ প্রভাব পড়েছে। একই মামলায় নওয়াজ কন্যা মরিয়মকে ৭ বছর এবং জামাতা ক্যাপ্টেন সবদারকে এক বছর জেল দিয়েছে আদালত। পাকিস্তানের সেনা বাহিনী ও বিচার বিভাগের সাথে প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যাবার পর এই দন্ডাদেশকে নওয়াজের রাজনৈতিক জীবনের আপাত পরিসমাপ্তি বলে মনে করছেন অনেকে। নওয়াজ মুসলিম লীগের সভাপতি শাহবাজ শরীফ এই রায় ঘোষণার সাথে সাথে দিনটি কলঙ্ক দিবস হিসাবে চিহ্নিত হবে বলে উল্লেখ করে মন্তব্য করেন, ২৫ জুলাই জনতার আদালতে বিচার বিভাগের এই রায় প্রত্যাখ্যাত হবে। ঠান্ডা মাথার মানুষ হিসাবে পরিচিত শাহবাজ দৃশ্যত বড় ভাইয়ের দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও তা নিয়ে রাজপথে অস্থিরতা সৃষ্টির পরিবর্তে নির্বাচনে এর ইতিবাচক প্রভাব নিয়ে আসার কথাই ভেবেছেন। কিন্তু নওয়াজের অনেক অনুসারী আদালতের রায়ের পর শাহবাজের এই বক্তব্য ও নমনীয় অবস্থানকে নওয়াজের জন্য দ্বিতীয় আঘাত হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
নওয়াজ শরীফ এখন ক্যান্সারে আক্রান্ত স্ত্রীর সশ্রুষার জন্য লন্ডনে অবস্থান করছেন । সেখান থেকেই তিনি এবং কন্যা মরিয়াম নওয়াজ সাংবাদিক সম্মেলন করে রায় মোকাবেলার জন্য পাকিস্তান ফিরে আসার ঘোষণা দেন। তবে তিনি কবে আসবেন সে রকম কোন সুনির্দিষ্ট কথা উল্লেখ করেননি। নির্বাচনের আগে যদি তিনি ফিরে না আসেন তাহলে এটি দলের নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। আর যদি এর মধ্যে ফিরে আসেন তাহলে তিনি দন্ড কার্যকর হবার পরিস্থিতির মুখে পড়বেন। এই অবস্থায় তিনি কি সিদ্ধান্ত নেবেন সেটি কয়েক দিনের মধ্যে হয়তো স্পষ্ট হবে।
৫ জুলাইয়ের জাতীয় জবাবদিহিতা আদালতের এই মামলার রায় হবার দিন আগেই নির্ধারিত ছিল। নওয়াজ চেয়েছিলেন তার স্ত্রীর অসুস্থতার কথা বলে এর দিন পেছাতে। আদালত তার সেই আবেদন গ্রহন করেনি। এই আর্জি গ্রহণ না করার পেছনে এর মধ্যেই তিনি কিছু জেনারেল এবং বিচার বিভাগের ব্যাপারে তার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি সেটাকে ছড়িয়ে দেবার চিন্তাও করে থাকতে পারেন। নওয়াজ অভিযোগ যাই করুন না কেন দেশটিতে এখন যা হচ্ছে তার অনেক কিছুর পেছনে যে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ‘ডিপ স্টেটের’ পরিকল্পনার যোগসূত্র রয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু ক্যারিজমেটিক চরিত্রের ব্যক্তিত্ব হবার পরও নওয়াজ শরীফ বার বার এই গভীর প্রভাব চক্রের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন । ফলে তিন বার ক্ষমতায় আসার পরও তিনি কোন বারই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি।
এর আগে সুপ্রিম কোর্ট পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারি মামলায় নওয়াজ শরীফকে সরকারি পদে থাকার অযোগ্য ঘোষণার পর স্পষ্ট হয়েছিল যে পাকিস্তানে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যত এক প্রকার সমাপ্তির দিকে চলে এসেছে। তিনি এই বার্তাকে গ্রহণ না করে এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়েছেন এবং তার রাজনৈতিক ক্ষমতা দিয়ে সেনা প্রতিষ্ঠান এবং বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য লড়াইয়ে নেমে পড়েছেন। এই লড়াইয়ে তার প্রতি জনসমর্থনের বৃদ্ধির প্রবণতা দেখে তিনি আরো উতসাহে মাঠে নামেন। কথিত ডিপ স্টেট ভারতে মুম্বাই হামলার জন্য লোক জন পাঠিয়েছে এমন সর্বনাসা বক্তব্য রাখতে গিয়ে এর পরিণতি কি হতে পারে তা নিয়ে তিনি ভাবেননি।
ক্ষমতায় থাকতে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ট ব্যবসায়ী গ্রুপের সাথে ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রের বাণিজ্যিক সম্পর্ক তৈরির মাধ্যমে পাকিস্তানে যে গভীর নিরাপত্তা উদ্বেগ তৈরি করেছিলেন এই বক্তব্য দিয়ে সেটিকে আরো গভীর করেছেন। এর আগে তিনি নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে ভারতের সাথে বিশেষ সৌহার্দের সম্পর্ক নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে মোদি শরীফের পরষ্পরের বাসগৃহে আসা যাওয়ার ঘটনা গণমাধ্যমের প্রচার প্রচারণায় যতটা দেখা গেছে বাস্তব সম্পর্ক উন্নয়নে সে রকম কিছুই হয়নি। বরং সেনা প্রতিষ্ঠানের সাথে তখন থেকেই নওয়াজের দূরত্ব বাড়া শুরু হয়।
এবার পাকিস্তানের নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হবার পর জনমত জরীপগুলোতে নওয়াজ মুসলিম লীগের সমর্থন বেশ চাঙ্গা হতে দেখা যায়। এটি ২০১৫ সালের ২৭ শতাংশ থেকে মে ২০১৮ তে ৩৮ শতাংশে গিয়ে উন্নীত হয়। কিন্তু জবাদদিহিতা আদালতের রায়ের সময় ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে এই সমর্থন আবার নিম্নুমখি হয়ে পড়ে। গ্যালপ পাকিস্তানের সর্বশেষ গত ৬ জুনের জরীপে দেখা যায় নওয়াজ লীগের সমর্থন ( ২৬ শতাংশ) আর ইমরান খানের পিটিআইয়ের সমর্থন (২৫ শতাংশ) ১ শতাংশের ব্যবধানে চলে এসেছে। কোন কোন জরিপে (পাস কনসালটেন্ট) ইমরান খানকে অগ্রগামিও দেখানো হচ্ছে। এই জরিপ অনুসারে নওয়াজ লীগের সমর্থন রয়েছে ২৭ শতাংশ আর ইমরানের দলের সমর্থন রয়েছে ৩০ শতাংশ। এতে ইমরান খান বেশ উল্লসিতও হয়েছেন।
ইমরান খান নওয়াজের দন্ডাদেশকে নতুন পাকিস্তানের অভিযাত্রা হিসাবে দেখতে চাইছেন। তবে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানে নির্বাচনের ফলাফল কোন দিকে মোড় নেবে তা নির্ভর করবে এখনো সিদ্ধান্ত না নেয়া ২০ শতাংশ ভোটারের উপর। নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে তারা সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এই ধারাটি নওয়াজের রায়ের পর যদি ইমরান খানের দিকে ঝুঁকে পড়ে তাহলে এই সাবেক ক্রিকেট তারকার প্রধানমন্ত্রী হবার স্বপ্ন পূরণ অসম্ভব কিছু নয়। তবে এখনো পর্যন্ত পাঞ্জাবের সব অংশেই নওয়াজ মুসলিম লীগের সমর্থন অক্ষুণ্ণ রয়েছে।
পাঞ্জাবের নির্বাচন নিয়ন্ত্রণকারী বিভিন্ন বুর্জোয়া ও ভুস্বামী পরিবারের সমর্থন আদায়ের ব্যাপারে ইমরানের চেষ্টা রয়েছে তবে সেই চেষ্টায় এখনও বড় কোন সাফল্য দেখা যাচ্ছে না। পাঞ্জাবে নওয়াজের ৪০ থেকে ৫১ শতাংশ সমর্থনের বিপরীতে ইমরানের সমর্থন দেখা যায় ৩০ শতাংশের আশে পাশে। সেটিও যদি বিশেষ কোন অঞ্চলে আসন জেতার মতো প্রাধান্যপূর্ণ করা যায় তাহলে খায়বার পাকতুন খোয়ায় তার যে ভোট ভিত্তি রয়েছে তার সাথে যুক্ত হবার পর সর্বাধিক আসন প্রাপ্তির অবস্থানে যাওয়া ইমরানের পক্ষে সম্ভব।
সিন্ধুতে এখনও পিপিপির আধিপত্য ক্ষুণ্ন হবার মতো অবস্থা সৃষ্টি হয়নি। সেখানে প্রভাবশালী কয়েকটি পরিবার ও দলের সাথে সমঝোতা তৈরির একটি চেষ্টা রয়েছে। কিন্তু এই চেষ্টা সিন্ধু থেকে কিছু আসন পিটিআইয়ের যোগ করবে এমন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়নি। ইমরান তার নির্বাচনী প্রচারাভিযানে নওয়াজ লীগ ও পিপিপির সাথে কোন কোয়ালিশন না করার ঘোষণা দিয়েছেন। তার অর্থ হলো তিনি কিছু আঞ্চলিক দলের সাথে হয়তো কোয়ালিশনের কথা ভাবছেন।
ইমরানের জন্য সদ্য গঠিত ইসলামিস্টদের জোট এমএমএ চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা দুটোই নিয়ে এসেছে। জামায়াতে ইসলামী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামসহ ইসলামী দলগুলোর অধিকাংশ ২০০২ সালে গঠিত এ মোত্তাহিদা মজলিসে আমল জোটে ছিল। এখন সেই জোটকে পূনরুজ্জীবিত করা হয়েছে। এমএমএ ২০০৩ সালের নির্বাচনে তৃতীয় বৃহত্তম জোট হিসাবে আবির্ভুত হয়ে ৬০ টি আসন লাভ করেছিল। পরে দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব সৃুষ্টির কারণে জোট ভেঙে যায়। এখন পূনরুজ্জীবিত জোট নানান সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনের চেষ্টা করছে। এই জোটের জন্য সম্ভাবনার ক্ষেত্র হচ্ছে খায়বার পাকতুন খোয়া এবং বেলুচিস্তান। পাঞ্জাব এবং করাচির কিছু কিছু আসনে জোট প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারে। তবে পাকিস্তানের মূল ধারার গণমাধ্যম এবং জরিপ প্রতিষ্ঠানগুলো এমএমএ’র সমর্র্থন নিয়ে তেমন কোন আলোচনাই করছে না। এটি দুটি কারণে হতে পারে। প্রথমত, আসলেই জোটটি হয়তো বা আগের আবেদন হারিয়ে ফেলেছে। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিভাবে ইসলামিস্টদের দমিয়ে রাখার নীতির অংশ হিসাবে তাদের সরকারি কোন ভুমিকায় যাবার মতো অবস্থা সৃষ্টি হোক তা চাইছে না প্রভাবশালীরা।
নির্বাচনী প্রবণতা অনুসারে পাকিস্তানের ৪টি প্রদেশে চারটি দল বা জোট সরকার গঠনের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। মুসলিম লীগ নওয়াজ পাঞ্জাবে, পিপিপি সিন্ধুতে, পিটিআই খায়বার পাখতুন খোয়ায় এবং এমএমএ বেলুচিস্তানে জনসমর্থনের বিবেচনায় এগিয়ে আছে। এক্ষেত্রে পাঞ্জাব ও সিন্ধে আগের অবস্থার বড় কোন পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম। বাকি দুটো প্রদেশে কি ফলাফল হবে সেটি নতুন মেরুকরণের উপর নির্ভর করবে।
সার্বিকভাবে পাকিস্তানে সরকার গঠন এবং প্রধানমন্ত্রী হবার প্রতিযোগিতার সামনে রয়েছেন ইমরান খান এবং শাহবাজ শরীফ। তবে প্রভাবশালী পক্ষগুলোর সমর্থন ইমরান যতটা পাবেন ততটা সম্ভবত পাবেন না শাহবাজ। তবে এখনো তিন সপ্তাহের কাছাকাছি সময় বাকি রয়েছে পাকিস্তানের নির্বাচনের। এ সময়ে অনেক পরিবর্তন দেখা যেতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানের অনেক গভীর নিরাপত্তা ভিত্তি রয়েছে। এখানে কোন একটি পক্ষ রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসাবে গণ্য হলে তার পক্ষে সামনে আগানো বেশ খানিকটা কঠিন। এই দিকটি নওয়াজের রাজনৈতিক জীবনকে সমাপ্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আর ইমরান খানকে দৃশ্যপটের সামনে এগিয়ে দিচ্ছে।
ইসলামিস্টদের মুখ্য রাজনৈতিক ভুমিকায় আসতে দুটি কারণে আরো সময় লাগবে। প্রথমত, জনমুখি বা জনকল্যাণের রাজনীতিকে যেভাবে মখ্য করে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন সেভাবে তারা সমর্থ হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত ইসলামিস্টদের জন্য সরকারি পর্যায়ে কোন রুল না দেবার ব্যাপারে এক ধরনের প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক পরিসরে সক্রিয় রয়েছে।
পাকিস্তানের এবারের নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত কি হবে সেটি বুঝার জন্য দৃশ্যপটের প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে যেসব ঘটনা ঘটছে তার প্রতি নজর রাখতে হবে। এক্ষেত্রে দেশটির অভ্যন্তরীণ ও বাইরের নানা পক্ষ প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টায় সক্রিয় রয়েছে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে ইমরান খান ক্ষমতায় যাবার ব্যাপারে নানা দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন।